প্রসারিত হোক পুরুষ নামক অভিভাবকদের একটা হাত, পাল্টে যাক পুরো গল্পের দৃশ্যপট
২৩ অক্টোবর ২০২১, সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন এর একটা গুরুত্বপূর্ণ পোষ্টে চাকরির পরীক্ষার সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছিল। সৌভাগ্যবশত আমি নিজেও সেই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিলাম।পুরো পরীক্ষার কেন্দ্র জুড়ে স্বাভাবিক ভাবেই মেয়ে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে খুবই কম।এরই মাঝে এক আপুকে দেখলাম। শাঁখা সিঁদুর পরে তিনিও সবার মতো পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য অপেক্ষারত।তবে অচেনা শহরে তার সাথে অভিভাবক হিসেবে এসেছেন তার বোন। একাডেমিক শিক্ষায় মেধাতালিকায় প্রথম দিকে অবস্থানরত এই মেয়েটির স্বামীর ভীষণ আপত্তি রয়েছে কর্মক্ষেত্রে নিজের স্ত্রীর প্রবেশ নিয়ে। কিন্তু দিনের পর দিন রাত জেগে পড়াশোনা করে একাডেমিক শিক্ষার শেষ সার্টিফিকেট অর্জনকারী মেয়েটির কাছে এমন আবদার অস্বস্তিকর,সেটা তার চোখ মুখ দেখলেই বোঝা যায়।তবু নিজের শেষ মেধাটুকু কাজে লাগিয়ে তিনিও হয়ে উঠতে চান অনন্যা। কিন্তু আজকের এই পুরুষ শাসিত সমাজে মেয়েদের মেধাবী হওয়াটাও অন্যায়। একাডেমিক শিক্ষাটুকু পুঁজি করে একবার বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারলেই দায়িত্ব নিয়ে মেয়েদের স্বপ্নগুলোকে শেষ করে দেওয়ার দায়িত্বে নেমে পড়েন আজকের তথাকথিত শিক্ষিত পুরুষ শাসিত সমাজ। যেখানে প্রতিটি মেয়েকে জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে শুনতে হয় "কিসের অভাব তোমার? কী চাই? কতো টাকা দরকার? কেনো তুমি চাকরি করবে?"
কখনোবা বাবা,ভাই কিংবা স্বামীর মুখে শুনতে হয় তুমি চাকরি করলে সমাজে আমাদের অসস্মানিত হতে হবে। হায়রে সমাজ!একটা মেয়ের মৌলিক অধিকারের মৃত্যু ঘটে তোমাদের অবান্তর আবদারে। আবার পুরুষ শাসিত এই সমাজই যোগ্যতার হাজারো প্রশ্ন তুলে একটা মেয়েকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দেয় কতো সহযে! মুহূর্তের মধ্যেই তখন ভুলে যায় নিজেদের বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট গণ্ডি নামক নিষেধাজ্ঞার কথা। কিন্তু স্বপ্ন ভাঙ্গার আর্তনাদে ক্লান্ত মেয়েটিকে এই অবান্তর আবদার মেনে বেঁচে থেকে পান করতে হয় অদৃশ্য হেমলক।তবু মুক্তির উপায় কোথায়?? চারিদিকে শুধু শৃঙ্খল আর শৃঙ্খল। নিজের স্ত্রীকে যেখানে বন্দি করে বাবা হওয়ার আনন্দে নিজের কন্যা সন্তানকে মুক্তির স্বাদ দিতে এই পুরুষ শাসিত সমাজের কোনো প্রতিনিধিই তখন শোনান ক্যারিয়ার গড়ার গল্প।স্বপ্ন দেখেন মেয়ের সাফল্যে গর্বিত পিতা হওয়ার আনন্দে নিজেকে ভাসিয়ে নেওয়ার। কিন্তু আবারো তার মেয়েকে আটকে দেয় তারই মতো কোনো পুরুষ।যে স্বামী হওয়ার অধিকারে নিজের স্ত্রীকে ভাবে নিজের একান্ত অনুগত অনুচর।যার জন্য মুক্তির স্বাদ অসম্ভব। নিয়মের শৃঙ্খলে তাই আজও এই পুরুষ শাসিত সমাজে মেয়েদের নিজের পরিচয়ে বেঁচে থাকার যুদ্ধও কম নয়। কিন্তু সেখানে বিজয়ী হওয়া কিংবা যুদ্ধে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। তবু অদম্য আগ্ৰহে এগিয়ে যাওয়া মেয়েটিকে অবরুদ্ধ করার শক্তিও নেই এসব অসুস্থ মানুষদের। সাময়িক মানুসিক অশান্তিকে সঙ্গী করে নিজের ইচ্ছে শক্তি আর মেধাকে কাজে লাগিয়ে নারীরা আজ ঘুড়ে দাঁড়াতে সক্ষম। যেখানে তাদের জন্য অনুপ্রেরণা যোগান আজ থেকে প্রায় শতবছর আগে এই সমাজকে অবরোধ থেকে মুক্ত করার চেষ্টায় নিজের সবটুকু মেধা দিয়ে মেয়েদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে বাধ্য করা মহীয়সী নারী বেগম রোকায়া কিংবা অন্যায়ের সাথে আপসহীন ইলা মিত্র অথবা সাহসিকা জননী সুফিয়া কামাল।
নতুন করে শুরু হয় স্বপ্ন বোনা।শত অবজ্ঞা, অবান্তর নিষেধাজ্ঞা,মানুসিক অশান্তিকে টপকে যখন কোনো মেয়ে পৌঁছে যান সাফল্যের চূড়ায়,তখন যেনো অকল্পনীয় প্রশংসায় মত্ত হয়ে পড়েন সবাই। তাদের তৈরি করা নিষেধাজ্ঞার অদৃশ্য কাঁটাতারে রক্তাক্ত মেয়েটাকে ভীষণ যত্নে তখন আগলে রাখার চেষ্টা চলে খুব। কিন্তু ক্ষতবিক্ষত মেয়েটি যখন উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু অর্জন করতে পারেন অসংখ্য বাঁধা অতিক্রম করে তখন এমন অবান্তর যত্ন কিংবা ভালোবাসায় তিনিও হয়ে উঠেন চরম বিরক্ত। নিজের জাগ্ৰত বিবেক তখন নিজের অজান্তেই বলে ওঠে "There is no need for you to organize this."
সবাই তখন একসাথে বলে উঠে, "মেয়েদের নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে দেওয়াটাই অন্যায়। একবার নিজের পায়ে দাঁড়ালে তারা কখনো পরিবারকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারে না।" কিন্তু এই দাঁড়ানোর পিছনের গল্প টা কখনো খুঁজতে যায় না কেউ।দেখতে চায় না নির্ঘুম রাতে আলো আঁধারের খেলাতে নিজেকে গড়ার যুদ্ধ। ভয়, আতঙ্ক আর কষ্টকে আলিঙ্গন করে ঘুরে দাঁড়ানোর যুদ্ধটা শুধু মাত্র একটা মেয়েকে করতে হয় এই সমাজে নিজেকে একজন মানুষ হিসেবে টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু একটুখানি সম্মান আর সহযোগিতায় পুরুষ নামক অভিভাবকদের প্রসারিত একটা হাত পাল্টে দিতে পারতো পুরো গল্পটাকে।
লেখাঃ মোহনা ইসলাম ডিনা
শিক্ষার্থী, মাস্টার্স শেষ পর্ব( বাংলা বিভাগ)
বাগেরহাট সরকারি প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজ।
কোন মন্তব্য নেই