বিজয়ের সুবর্ণ জয়ান্তীঃ তরুন প্রজন্মের ভেতর কতটা লালিত হচ্ছে বিজয়ের ইতিহাস? - মোহনা ইসলাম ডিনা
আজ বুধবার,১৫ই ডিসেম্বর। বিজয়ের ৫০ বছর পেরিয়ে সুবর্ণ জয়ন্তীর দাঁড় প্রান্তে আমরা।যেখানে প্রাপ্তির সীমাহীন আনন্দে আমরা ভুলেছি দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে স্বজন হারানোর যন্ত্রনা। কিন্তু বিজয়ের এই আনন্দের পিছনে যাঁদের আত্মত্যাগের অবদান ছিল সীমাহীন তাঁদের সম্পর্কে কতোটা জানে আজকের কিশোর ও তরুন সমাজ? বৃহস্পতিবার, ১৬ই ডিসেম্ববর। বিজয়ের ৫০ বছর পেরিয়ে আমরা পালন করতে যাচ্ছি বিজয়ের সুবর্ণ জয়ান্তী। বাঙালি জাতির প্রতিটি বিশেষ ঘটনার সাক্ষী সপ্তাহের এই দিনটি।'৫২ এর ভাষা আন্দোলন কিংবা'৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান সব ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাথে জড়িয়ে আছে বৃহস্পতিবারের এক অদ্ভুত সাদৃশ্য। দীর্ঘ ৫০ বছর পেরিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর ত্রিশ লক্ষাধিক শহীদের রক্ত আর দুই লক্ষ মা বোনের ত্যাগের মহিমায় আমরা পেয়েছিলাম ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটুকরো স্বাধীন ভূখণ্ড। ৫০ বছর আগের সেই দিনটির সাথে এবারের বিজয় দিবসের অদ্ভুত এক মিল,১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ছিল বৃহস্পতিবার।এবারের ১৬ই ডিসেম্বরও বৃহস্পতিবার। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বিজয়ের উল্লাস জুড়ে যে আনন্দে দিশেহারা বাঙালি জাতি,সেই আনন্দকে চির অক্ষত করতে যাঁদের অবদান ছিল অনস্বীকার্য সেই বীর সন্তানদের কথা মনে করে অনুজ আমার মতো অনেক বাংলা মায়ের সন্তানের চোখ ভিজে যায় অদৃশ্য যন্ত্রনার দগ্ধতায়।অথচ এই দেশকে বাঁচিয়ে রাখতে যে কাঁকন বিবিরা সব হারিয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কের আমরা কতটুকু জানি?? সদ্য স্কুল পাশ করা মেধাবী কিছু ছেলেমেয়েদের মাঝে "মাছরাঙা টেলিভিশন" এর প্রতিবেদকের এমন কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে একরাশ হতাশায় উত্তরের খাতা বন্ধ করতে বাধ্য হওয়া সেই প্রতিবেদনটা হয়তোবা এখনও মনে আছে সবার!এ ব্যর্থতা আমাদের। আমরা নিজেদের ইতিহাসকে লালন করতে পারি নি সঠিক মূল্যবোধে।তবে কি স্বাধীনতা অর্জন করলেও তা রক্ষা করার ক্ষমতা আমাদের মাঝে তৈরি করছে খানিকটা সংশয়?? আমরা অনেকেই আজও জানিনা মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর কিংবা ৬৪ টি সাবসেক্টর সম্পর্কে। জানিনা, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের নাম। অথচ এই বিজয় অর্জনে "বঙ্গবন্ধুর" ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন,লাল সবুজের পতাকা রক্ষায়। তবু এমন অনাকাঙ্ক্ষিত অজ্ঞতা আমাদের জন্যে চরম লজ্জার এবং ব্যর্থতার। কিন্তু এক সাগর রক্ত পেরিয়ে যে অর্জন এ জাতির, তা রক্ষা করার দায়িত্ব যে আজকের তরুণ প্রজন্মের। স্বাধীনতার অনেক রক্তিম সূর্যে আলোর মাঝে বেঁচে থাকার স্বপ্নে হয়তোবা বাংলার আনাচেকানাচে অনেক সূর্য সন্তানেরা আলো ছড়াচ্ছেন চির উজ্জ্বল কোনো নক্ষত্র হয়ে।আমরা তরুন প্রজন্ম কতোটুকু জানি তাঁদের সম্পর্কে? কখনো কি একবারও খুঁজে দেখেছি বিজয় অর্জনের মূল সুর, খুঁজে দেখা হয়েছে কি বিজয়ের মাহাত্ম্য? উত্তরটা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও হয়তোবা খোঁজা হয়নি কখনো! কিন্তু বছর জুড়ে এই একটা দিনেই যেনো আমরা সবাই দেশকে ভালোবাসার নেশায় মিশে যেতে চাই। কিন্তু কতোটুকু জানি আমরা, বিজয়ের ইতিহাস?? আজকের দিনে যে আনন্দে উদ্বেলিত আমরা তরুন প্রজন্ম,সেই আনন্দকে যথার্থ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার দায়িত্ব পালনে কতোটা স্বচেষ্ট আমরা? প্রশ্নটা কখনো করা হয়েছে নিজেদের কাছে? বিজয় দিবসের আনন্দকে ভাগ করে নিতে কতোটা দায়িত্ব আমাদের! বছরের এই একটা দিনই বোধহয় পতাকা আমাদের কপালে শোভা পায় পরম যত্নে! কিন্তু আজও আমরা বলতে ব্যর্থ সাত জন বীর শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার নাম।আমরা জানি না, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের তাৎপর্য, জানি না এই দিনে আমরা হারিয়েছি কাদের!জহির রায়হান, শহীদুল্লাহ্ কায়সার, মুনীর চৌধুরী, আলতাফ মাহামুদ, সেলিনা পারভীনদের মতো সূর্য সন্তানদের অবদান কিংবা আত্মত্যাগের মহিমা আমাদের কাছে খুব সাধারণ কোনো বাক্য ছাড়া বিশেষ কোনো গুরুত্ব বহন করে কি?? তরুণ মেধাবী ছাত্র, শহীদ রুমীর নাম জানি না এই প্রজন্মের অনেকেই। জানিনা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের অসীম অবদান জুড়ে বিজয়ের অর্জনের গল্প।অথচ আজকের এই অর্জনের পিছনে হারিয়ে গেছে কতো রুমির প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন। হারিয়ে গেছেন, ডাঃ আলীম চৌধুরীর মতন কতো মেধাবী মুখ! আজকের এই বিজয় অর্জনে আমরা হারিয়েছি বাংলার সবচেয়ে মেধাবী মানুষগুলোকে। হারিয়েছি আপনজন। কিন্তু প্রাপ্তিও কম না। নিজের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার আনন্দের কাছে স্বজনহারানোর ব্যাথাও যে তুচ্ছ।তবু নিজেদের দায়িত্বের জায়গায় আমাদের সক্রিয়তা কোথায়? কতোটুকু ধারণ করি আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা? সেতারা বেগম,তারামন বিবির ত্যাগের মহিমা আমাদের কতোটা অনুভূতির অনুভবে আঘাত করে? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে নেই। অথচ আমাদের পূর্ব পুরুষদের ত্যাগের মহিমা আর সংগ্ৰামের দৃঢ় প্রত্যয়ে উদ্ভাসিত হয়ে আজ আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক শ্যামল ভূখণ্ডে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাংলার কৃষক, তাঁতি,জেলে,ছাত্র, যুবক সবাই যেখানে একসাথে মিশে হেঁটেছিলেন প্রতিবাদের সারিতে। তাই আজকের দিনে অঙ্গীকার হোক তরুণ প্রজন্মের সবার, "শুধু মাত্র উল্লাসে নয়, বিজয়কে লালন করবো বিনম্র শ্রদ্ধা আর সঠিক ইতিহাসকে ধারণ করে।" বাঙালি বীরের জাতি।যে জাতি হায়নার কবল থেকে মুক্ত করছে নিজের জন্মভূমিকে সে জাতি বিজয়কে লালন করবে সঠিক মূল্যাবোধে এবং নিজেদের গড়ে তুলবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার যোগ্য কর্ণধার হিসেবে এমন প্রত্যাশা রইলো আজকের কিশোর এবং তরুণ প্রজন্মের প্রতি।।
লেখাঃ
মোহনা ইসলাম ডিনা, শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ (মাস্টার্স)সরকারি পিসি কলেজ,বাগেরহাট।।
কোন মন্তব্য নেই